পুঁইমাচা গল্পের মূলভাব-বিষয়বস্তু-সারাংশ

আজকে আমাদের বিষয় হল পুঁইমাচা গল্পের মূলভাব। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুইমাচা’ গল্পে গ্রামের এক দারিদ্র পরিবারের সাধারণ জীবন যাপনের কথার মাধ্যমে তার গল্প ফুটিয়ে তুলেছে। চলুন দেখে আসি পুঁইমাচা গল্পের বিষয়বস্তু-সারাংশ এবং মূলভাব।

পুঁইমাচা গল্পের মূলভাব-বিষয়বস্তু-সারাংশ
পুঁইমাচা গল্পের মূলভাব-বিষয়বস্তু-সারাংশ

পুঁইমাচা গল্পের মূলভাব

কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুইমাচা’ গল্পে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের দুঃখ – যন্ত্রণার কথা বর্ণিত হয়েছে। সহায়হরি চাটুয্যে এই ব্রাহ্মণ পরিবারের অসহায় কর্তা। তাঁর চার মেয়ে। মেয়েদের ঠিকমতাে ভরণপােষণ করার ক্ষমতা সহায়াহরির নেই। মানুষের কাছ থেকে এটা ওটা চেয়েচিন্তে এনে তিনি মেয়েদের খাওয়াতে চান। কিন্তু স্ত্রী অন্নপূর্ণ এটা একেবারেই পছন্দ করেন না। স্বামীর এই বেলাল্লাপনাকে তিনি কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেন। তাঁর কথা হলাে “ আমার জোটে খাব, না জোটে খাব না।” তাই, বলে তিনি যে মেয়েদের ভালােবাসতেন না তা নয়। অন্নপূর্ণা তাঁর মেয়েদের খুব ভালােবাসতেন। পুজো পার্বণের সময় যে করেই হোক তিনি মেয়েদের সাধ্যমতাে খাওয়ানাের চেষ্টা করতেন। কোন মেয়ে কী খেতে ভালােবাসে তা তিনি জানতেন। সেইমতাে যােগাড়েরও চেষ্টা চালাতেন।

এ ব্যাপারে তাঁর প্রচেষ্টার কোন কার্পণ্য কখনও দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে সহায়হরি ছিলেন একটু ভিন্ন প্রকৃতির। দায়িত্বজ্ঞানহীন এই ব্রাহ্মণ লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে চেয়ে না চেয়ে অপরের জিনিস বাড়িতে নিয়ে আসতেন। তাঁর পিতৃবাৎসল্য এতই প্রবল ছিল যে, স্ত্রীর তিরস্কারেও তিনি অবদমিত হতেন না। সহায়হরির আরেকর্টি অভ্যাস ছিল মাছ ধরার। এক্ষেত্রে তিনি প্রচণ্ড উৎসাহী ছিলেন। এসব কাজে ডুবে থাকতে গিয়ে বড় মেয়ে ক্ষেন্তির বিয়ের বয়স যে উত্তীর্ণ হতে চলেছে , এ ব্যাপারে তার খেয়াল থাকত না। এই নিয়ে স্ত্রী অন্নপূর্ণা তাঁকে ভৎসনা করতে ছাড়তেন না। অভাবের সংসারে দুঃখকষ্ট যন্ত্রণা যেন লেগেই থাকত। ক্ষেন্তির একবার বিয়ের সম্বন্ধ স্থির হয়েও ভেঙে গিয়েছিল। এ নিয়েও সামাজিক যন্ত্রণার অন্ত ছিল না। সেই মেয়ে এখন পনেরয় পা দিয়েছে, অথচ তার বিয়ের ব্যাপারে সহায়হরির গা নেই।

এজন্য অনুপর্ণার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ক্ষেন্তি পুঁইশাক খেতে খুব ভালােবাসত। একবার অরন্ধনের আগের দিন বাড়িতে পুঁইশাক রান্না হলে। ক্ষেন্তি একাই তার অর্ধেক খেয়ে ফেলেছিল। রায়েদের ফেলে দেওয়া পাকা পুঁইশাকের ডাটা সংগ্রহ করে ক্ষেন্তি বেঁধে খাওয়ার জন্য বাড়িতে নিয়ে এলে মা অন্নপূর্ণা তাকে তীব্র ভাষায় ভৎসনা করে সব ফেলে দিয়েছিলেন। পরে সেই শাকেরই কিছু অংশ রান্না হলে ক্ষেন্তি পরম তৃপ্তি সহকারে তা গলাধঃকরণ করেছিল। পছন্দসই খাবার পেলে ক্ষেন্তি খুব খেতে পারত।

একসাথে আঠারাে ঊনিশটা পিঠে সে সাবার করে দিত। এ নিয়ে সংসারে কখনও কোন কথা উঠত না। কোন প্রকার সংকোচ না করে সে মায়ের কাছ থেকে নারকেল কোরা চেয়ে নিয়ে গােগ্রাসে গিলত। রায়েদের ক্ষেত থেকে পাকা পুঁইশাক এনে মায়ের গালাগাল খাওয়ার পর ক্ষেন্তি কোথা থেকে একটা কুড়িয়ে পাওয়া পুঁইচারা নিয়ে এসে উঠোনের একপাশে পুঁতে দেয়। প্রতিদিন জল ঢেলে ঢেলে সে চারাটাকে বাঁচিয়ে তােলে। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তার জন্য একটা মাচাও তৈরি করে ক্ষেন্তি। কিন্তু এই পুঁইশাক খাওয়ার যােগ্য হওয়ার পূর্বেই ক্ষেন্তির বিয়ে হয়ে যায়। পাত্রটি ছিল চল্লিশাের্ধ।

পনেরাে টাকা বাকি থাকার কারণে ক্ষেন্তিকে আর বাপের বাড়িতে আসতে দেওয়া হয়নি। অবশেষে বছর ঘুরতে না ঘুরতে বসন্তরােগে আক্রান্ত হয়ে ক্ষেতি মারা গেল। এরপর কয়েক মাস কেটে গিয়েছে। আবার পৌষ পার্বণের দিন ঘনিয়ে এল। সন্ধ্যার সময় অন্নপূর্ণ রান্না ঘরের মধ্যে বসে মেয়েদের জন্য পিঠে তৈরি করছিলেন। পুঁটি ও রাধী উনােনের পাশে বসে আগুন পােয়াচ্ছিল। অনেক রাতে পিঠে তৈরি শেষ হলে অন্নপূর্ণা মেয়েদের পিঠে খেতে বসিয়ে দিলেন। তখন আকাশে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছে। পিঠে খাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে হঠাৎ পুঁর্টির ক্ষেন্তি দিদির কথা মনে পড়ল। দিদি যে পিঠে খেতে ভালােবাসতাে এ কথা তারা কেউ ভােলেনি। পুঁটি বলে উঠল দিদি বড় ভালােবাসত। সকলেই কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে রইল। তারপর তাদের সকলের দৃষ্টি একসাথে কেমন করে উঠোনের এক কোণে সেই পুঁইমাচার্টির উপর গিয়ে পড়ল।

পুঁইমাচাৰ্টি বাড়ির সেই পুইলােভী মেয়েটির স্মৃতি পাতায় পাতায় , শিরায় শিরায় জড়িয়ে কেমন ভরপুর হয়ে আছে। বর্ষার জল ও কার্তিকের শিশির গায়ে নিয়ে কচিকচি সবুজ ডগাগুলাে মাচা ছাড়িয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এর রচয়িতা আজ বেঁচে নেই। তাই যেন এতে কেউ হাতও দেয়নি।’ পুঁইমাচা’ গল্পে এক সহজসরল গ্রাম্য বালিকার পুঁইপ্রীতির অন্তরালে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ দম্পতির সন্তান বাৎসল্যের প্রাবল্যের চিত্র, অঙ্কিত হয়েছে। সহায়হরি তাঁর সন্তানদের মনােতুষ্টির জন্য এমন কোনাে কাজ নেই যা করতে পারতেন না। আবার আত্মমর্যাদা বজায় রেখে অন্নপূর্ণার সন্তানবাৎসল্য ফল্পধারার মতােই সর্বদা উৎসারিত হয়েছে। শত দারিদ্র্য তাঁদের বাৎসল্যকে ম্লান করতে পারেনি।

আরো পড়ুন: বার বার ফিরে আসে কবিতার মূলভাব

মাটি ও মানুষের প্রাণের স্পন্দন গল্পর্টির ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে। দারিদ্র জর্জরিত মাতৃহৃদয়ের কান্না ও পিতৃহৃদয়ের উচ্ছ্বাসে গল্পের আবহ ভারী হয়ে উঠেছে। জীবনের বেদনাদীর্ণ হাহাকার একটি পুঁইমাচাকে আশ্রয় করে ঝংকৃত হয়েছে।

আশাকরি পুঁইমাচা গল্পের মূলভাব, বিষয়বস্তু এবং সারাংশ কি তা উপরের নিবন্ধ পড়ে বুঝতে পেরেছেন। আরো কিছু জানার থাকতে নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন।

পুঁইমাচা গল্পের বিশেষ কিছু প্রশ্ন উত্তরঃ

প্রশ্ন:  পুঁইমাচা গল্পের প্রধান নারী চরিত্র কে?

উত্তর: পুঁইমাচা গল্পের প্রধান নারী চরিত্র ”ক্ষেন্তি” ।

প্রশ্ন: পুঁইমাচা গল্পের প্রধান প্রধান চরিত্রের নাম লেখ

উত্তর: সহায়হরি, অন্নপূর্ণ, ক্ষেন্তি, লক্ষ্মী পুঁটি ও রাধী ।

প্রশ্ন: পুঁইমাচা গল্পের লেখক কে?

উত্তর: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পুঁইমাচা গল্পের লেখক।

Leave a Comment